Home » » সূচক অপরিবর্তিত থাকলেও বেড়েছে বাংলাদেশের দুর্নীতি

সূচক অপরিবর্তিত থাকলেও বেড়েছে বাংলাদেশের দুর্নীতি

দুর্নীতির ধারণা সূচক (সিপিআই বা করাপশন পারসেপশন ইনডেক্স)র  মানদণ্ডে স্কোর বা নম্বর অপরিবর্তিত থাকলেও বাংলাদেশে দুর্নীতি বেড়েছে। দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে ১৩তম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। গতবছর এ অবস্থান ছিল ১৪তম। শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে যৌথভাবে এক নম্বরে রয়েছে সোমালিয়া ও উত্তর কোরিয়া। আর কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হচ্ছে ডেনমার্ক। বিশ্বজুড়ে একযোগে প্রকাশিত বার্লিনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই)র সিপিআই প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
সূচক অপরিবর্তিত থাকলেও বেড়েছে বাংলাদেশের দুর্নীতি
সূচক অপরিবর্তিত থাকলেও বেড়েছে বাংলাদেশের দুর্নীতি


প্রতিবেদনে বলা হয়, সূচকের মানদণ্ডে বাংলাদেশের স্কোর (২৫) গতবছরের মতো থাকলেও সাতটি দেশ এবার জরিপের আওতাভুক্ত হয়নি। এসব দেশ সব সময়ই বাংলাদেশের তুলনায় বেশি স্কোর পেয়েছে। ফলে সূচক অপরিবর্তিত থাকলেও বেড়েছে বাংলাদেশের দুর্নীতি।

বুধবার সকালে রাজধানীর ধানমণ্ডিতে নিজেদের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রতিবেদনটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। টিআইর পক্ষে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান প্রতিবেদন তুলে ধরেন।

টিআইর প্রতিবেদন প্রকাশের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত দুর্নীতি রোধে কোনো উন্নতি না হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘দুর্নীতির ব্যাপারটাতে আমরা টাচই করতে পারিনি।

প্রতিবেদনের তথ্য মতে, ২০১৫ সালের সূচকে অন্তর্ভুক্ত ১৬৮টি দেশের মধ্যে উচ্চক্রম (ভালো থেকে খারাপের দিকে) অনুযায়ী, বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৯তম। আগের বছর ১৭৫টি দেশের মধ্যে উচ্চক্রম অনুযায়ী, বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৪৫তম। সূচকের ১০০ মানদণ্ডের মধ্যে ২০১৫ সালে বাংলাদেশের স্কোর বা নম্বর ২৫। আগের বছর বাংলাদেশের স্কোর ছিল একই।

টিআইর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০১৫ সালে বিশ্বের সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ ডেনমার্ক। দেশটির স্কোর ৯১। এরপর রয়েছে যথাক্রমে ফিনল্যান্ড ও সুইডেন। সর্বনিু ৮ স্কোর নিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় যৌথভাবে শীর্ষে আছে উত্তর কোরিয়া ও সোমালিয়া। দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে আছে যথাক্রমে আফগানিস্তান ও সুদান।

বৈশ্বিক দুর্নীতি পরিস্থিতিক্রম : দুর্নীতির অবনতির তথ্য তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৫ সালের দুর্নীতির ধারণা সূচকে বৈশ্বিকভাবেই অবস্থার অবনতি হয়েছে। সূচকে কোনো দেশই শতভাগ স্কোর পায়নি। বিশ্বের সর্বোচ্চ উন্নত দেশগুলোর মধ্যে অস্ট্রেলিয়া, আইসল্যান্ড, বেলজিয়াম, জাপান, অস্ট্রিয়া, আয়ারল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, স্পেন, ইতালি প্রভৃতি দেশ ৮০ শতাংশের কম স্কোর পেয়েছে। ডেনমার্ক গতবার ৯২ স্কোর নিয়ে সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকার শীর্ষে থাকলেও এবার তাদের স্কোর ৯১। এছাড়া নিউজিল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রেলিয়া, লুক্সেমবার্গ ও সিঙ্গাপুরের মতো দেশের স্কোরেও অবনতি হয়েছে। টিআইর গতবছরের দুর্নীতি ধারণা সূচকে অন্তর্ভুক্ত বাহামা দ্বীপপুঞ্জ, বারবাডোজ, ডোমিনিকা, পোর্টোরিকো, সেন্ট ভিনসেন্ট ও গ্রানাডা, সামোয়া এবং সোয়াজিল্যান্ড- এ সাতটি দেশ এ বছর সিপিআই অন্তর্ভুক্ত হয়নি।

২০০১ সালে টিআইর বৈশ্বিক দুর্র্নীতির ধারণা সূচকে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল সর্বনিম্ন বা ১ম। এ অবস্থান ২০০৫ সাল পর্যন্ত অপরিবর্তিত ছিল। এরপর ২০০৬ সালে ৩য়, ২০০৭ সালে ৭ম২০০৮ সালে ১০ম, ২০০৯ সালে ১৩তম, ২০১০ সালে ১২তম, ২০১১ ও ২০১২ সালে ১৩তম, ২০১৩ সালে ১৬তম এবং ২০১৪ সালে ১৪তম অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ। এবার (২০১৫) এ অবস্থান দাঁড়ায় ১৩তম।

১৯৯৫ সাল থেকে ব্যবহৃত ০-১০ স্কেলের পরিবর্তে দুর্নীতির ধারণা মাত্রাকে ২০১২ সাল থেকে ০-১০০ স্কেলে নির্ধারণ করা হয়। সিপিআই সূচকে স্কোরকে দুর্নীতির ব্যাপকতার ধারণায় সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত এবং ১০০স্কোর বা নম্বরকে সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত বা সর্বোচ্চ সুশাসন প্রতিষ্ঠিত দেশ বলে ধারণা করা হয়। ২০১৩ সালে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ২৭, তার আগের বছর ছিল ২৬। ২০১৪-এ স্কোর ছিল ২৫। ২০১৫ সালে তা অপরিবর্তিত থাকে।

এবারের সূচকের জন্য বাংলাদেশের ক্ষেত্রে টিআই ৭টি জরিপ ব্যবহার করেছে। এগুলো হচ্ছে- বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি পলিসি অ্যান্ড ইন্সটিটিউশনাল অ্যাসেসমেন্ট-২০১৪, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম এক্সিকিউটিভ অপিনিয়ন সার্ভে-২০১৫, বার্টেলসম্যান ট্রান্সফরমেশন ইনডেক্স-২০১৬, ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্ট রুল অব ল ইনডেক্স-২০১৫, পলিটিক্যাল রিস্ক ইন্টারন্যাশনাল কান্ট্রি রিস্ক গাইড-২০১৫, ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিট কান্ট্রি রিস্ক রেটিংস-২০১৫ এবং গ্লোবাল ইনসাইট কান্ট্রি রিস্ক রেটিংস-২০১৪।

টিআইর তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ ভুটান। ২০১৫ সালে দুর্নীতির সূচকে দেশটির স্কোর ৬৫ এবং ঊর্ধ্বক্রম অনুযায়ী (ভালো থেকে খারাপের দিকে) অবস্থান ২৭। এর পরে ভারতের স্কোর ২৮ এবং দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে অবস্থান ৭৬তম। ৩৭ স্কোর পেয়ে ৮৩তম অবস্থানে রয়েছে শ্রীলংকা, ৩০ স্কোর পেয়ে ১১৭তম অবস্থানে রয়েছে পাকিস্তান এবং ২৭ স্কোর পেয়ে ১৩০তম অবস্থানে রয়েছে নেপাল। ১১ স্কোর পেয়ে ১৬৬তম অবস্থানে রয়েছে আফগানিস্তান। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে উচ্চক্রম অনুযায়ী অবস্থানে ২০১৪ সাল থেকে ২০১৫-এর সূচকে অগ্রগতি হয়েছে ভারত ও পাকিস্তানের (৯ ধাপ)। বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান এগিয়েছে ৬ ধাপ, ভুটান এগিয়েছে ৩ ধাপ এবং শ্রীলংকা ২ ধাপ।

সিপিআই প্রতিবেদন তুলে ধরে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘স্কোর ভালো করার সুযোগ থাকলেও বাংলাদেশ তা করতে পারেনি। বৈশ্বিক গড় স্কোরের তুলনায় বাংলাদেশের ২০১৫ সালের স্কোর অনেক কম। তাই বাংলাদেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা ও গভীরতা এখন উদ্বেগজনক। দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহের মধ্যে এবারও বাংলাদেশের অবস্থান আফগানিস্তানের পর দ্বিতীয় সর্বনিম্ন। নিম্নক্রম অনুযায়ী বাংলাদেশ এবার ২০১৪ সালের ১৪তম অবস্থানের একধাপ নিচে ১৩তম, যা ২০১৩ তুলনায় ৩ ধাপ নিচে ও ২ পয়েন্ট কম। অর্থাৎ সার্বিক বিবেচনায় এবারও আমাদের অগ্রগতি হল না।

তিনি বলেন, ‘উচ্চক্রম অনুযায়ী ২০১৫ সালে বাংলাদেশের ছয় ধাপ অগ্রগতি কিছুটা সন্তোষজনক মনে হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে তা হওয়ার কারণ, সাতটি দেশ এবার জরিপের আওতাভুক্ত হয়নি। এসব দেশ সব সময়ই বাংলাদেশের তুলনায় বেশি স্কোর পেয়েছে। এছাড়া বৈশ্বিক গড় স্কোরের তুলনায় বাংলাদেশের ২০১৫ সালের স্কোর অনেক কম। গতবারের মতো একই স্কোর নিয়ে এবারও দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয় সর্বনিম্ন হওয়ায় দেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা ও গভীরতা এখনও উদ্বেগজনক। এ প্রেক্ষাপটে দুর্নীতি দমনে রাজনৈতিক  অঙ্গীকার বাস্তবায়নে আরও কঠোর ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ এবং দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) জবাবদিহিমূলক অপরাপর প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেই নেতৃত্ব দিতে হবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে দুর্নীতিবাজ ও দুর্নীতির প্রশ্রয়কারীদের চিহ্নিত করে যথাযথ শাস্তির বিধান করা গেলে দুর্নীতি অনেক কমে আসবে।

যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইন্সটিটিউটের (আইআরআই) এক জরিপের ভিত্তিতে দেশের একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরে উন্নয়ন ও গণতন্ত্র বিষয়ে কথা বলেন টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল।  তিনি বলেন, ‘দেশের উন্নয়ন হলেও উন্নয়নের সঙ্গে দেখতে হবে দুর্নীতি কমেছে কিনা। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ঠিক আছে কিনা। গণতন্ত্রের বিনিময়ে উন্নয়ন কতটা গ্রহণযোগ্য সেটা নিয়ে ভাবার অবকাশ রয়েছে। সিপিআই র‌্যাংকিংয়ে আমাদের স্কোর গতবারের চেয়ে কমে না যাওয়াটা কিছুটা স্বস্তি পেলেও আমাদের বসে থাকলে চলবে না। কারণ আমরা এখনও গড় যে স্কোর তার কাছাকাছিও পৌঁছাতে পারিনি।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে টিআইবির চেয়ারপারসন বলেন, ‘একটি পত্রিকায় আজ আরেকটি জরিপের কথা এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে, উন্নয়নের কারণে জনগণ গণতন্ত্রের দুঃখ ভুলে গেছে। কিন্তু গণতন্ত্রের দুঃখ ভোলার নয়; গণতন্ত্রের বিনিময়ে উন্নয়ন কতটা গ্রহণযোগ্য সেটা নিয়েও ভাবার অবকাশ আছে। কারণ গণতন্ত্র বাস্তবায়ন না হলে সাধারণ জনগণ উন্নয়নের সুফল পায় না।
টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য এম. হাফিজউদ্দিন খান বলেন, ‘যদি সংসদীয় কমিটিগুলো কার্যকর হয়, প্রশাসনযন্ত্র সংসদের জবাবদিহিতার মধ্যে থাকে, বিরোধী দল কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে, তাহলে আমাদের অবস্থার আরও উন্নতি হতে পারে। 


সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির পক্ষ থেকে বলা  হয়, সিপিআই নির্ণয়ে টিআইবি কোনো ভূমিকা পালন করে না। এমনকি টিআইবির গবেষণা থেকে প্রাপ্ত কোনো তথ্য বা বিশ্লেষণ সিপিআইয়ে পাঠানো হয় না। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের টিআই চ্যাপ্টারের মতোই টিআইবিও দুর্নীতির ধারণা সূচক দেশীয় পর্যায়ে প্রকাশ করে মাত্র। ২০১৫ সালের সিপিআইয়ে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত সময়ের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।

0 comments:

Post a Comment

Popular Posts

Blog Archive

Powered by Blogger.